বরিশালে বেড়ে চলছে শিশুশ্রম : বন্ধে নেই কোন কার্যকর পদক্ষেপ।
বরিশাল জেলার সকল উপজেলার সর্বত্রই ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশু শ্রমিকের ব্যবহার দিনকে দিন উদ্বেগজনক হারে বেড়েই চলেছে। বিভিন্ন এলাকার চায়ের দোকান আর ওয়েল্ডিং দোকানগুলোতে দেদারছে চলছে শিশু শ্রমিকের ব্যবহার। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য উন্নয়নমুখি কিছু কর্মসূচির কথা বলা হলেও শিশুশ্রম বন্ধে কোনো প্রতিষ্ঠানেরই যেন নেই কোনো মাথা ব্যথা। নেই কোনো আইনি পদক্ষেপ। শুধু বেঁচে থাকার তাগিদে অল্প বয়সী এসব শিশুরা অমানবিক পরিশ্রম করছে। আবার অনেক শিশুরা ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত থেকে বড় ধরনের দূর্ঘটনার শিকার হয়ে পঙ্গুত্ব বরন করে। বরিশাল বিভাগসহ জেলার অধিকাংশ অঞ্চলের ইটের ভাটা, লোহার তৈরি মেশিনের কারখানা, লেদ মেশিন কারখানায়, বাস, ট্রাক ও লঞ্চ মেরামতের কাজে নিয়োজিত রয়েছে প্রায় লক্ষাধিক শিশু। এছাড়াও ভিক্ষাবৃত্তি ও টোকাইয়ের কাজে নিয়োজিত প্রায় অগনিত শিশু। এসব শিশুদেরকে সুরক্ষার জন্য বা লেখাপড়া করিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে দেশের সরকারের একাধিক সংস্থা বা বিভিন্ন নামি দামী এনজিও কাজ করলেও তাদের সঠিক লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেনি। বরিশাল নগরীর ৫ নং ওয়ার্ড পলাশপুর, মোহাম্মদপুর ও রসুলপুর চরে বসবাসরত প্রায় লক্ষাধিক মানুষের মধ্যে সুবিধা বঞ্চিত ও অবহেলিত প্রায় লক্ষাধিক শিশু রয়েছে। এসব শিশুরা অধিকাংশই দরিদ্র পরিবারের যাদের নুন আনতে পান্তা ফুরানোর মত অবস্থা তাদের পরিবারের শিশুদের একটু বেড়ে ওঠার আগেই পরিবারের চাহিদা মেটানোর জন্য পাঠিয়ে দেয়া হয় ঝুঁকিপূর্ন কাজে। অনেক সময়ে এসব শিশুর শারীরিক গঠন ও সুষ্ঠু ভাবে হয় না। কিছু কিছু পরিবারের সদস্যরা নিজেরা কর্মক্ষম হওয়ার পরেও ঘরে বসে থেকে শিশুদের দিয়ে কাজ করিয়ে সংসারের জোগান দিচ্ছে অথচ এর ফলে যে ওই শিশুর জীবন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে সম্ভাবনাময় ভবিষৎ সেদিকে নজর দিচ্ছে না কেউ। সরেজমিনে গিয়ে দেখাগেছে, অনেক পরিবারের পিতা-মাতার অবহেলায় ঝড়ে পরছে তার অবুঝ শিশুটির জীবন। হয়ে যাচ্ছে পথ শিশু না হয় হারিয়ে যাচ্ছে অনিশ্চিত ভূবনে। এ ছাড়ারাও শিশুদের দিয়ে মাদক বহন করা সহজ ও প্রশাসনের নজরের বাইরে থাকায় নগরীর কেডিসি বালুর মাঠ কলোনী (বস্তি), ভাটার খাল কলোনী (বস্তি) ও পলাশপুর বস্তির কিছু শিশুদের দিয়ে সুকৌশলে মাদক বহন করাচ্ছে সমাজের মাদক ব্যবসায়ীরা। বরিশালে গড়ে প্রতিদিনই বাড়ছে ঝুঁকিপূর্ন শিশুর ও সুবিধা বঞ্চিত শিশুর সংখ্যা। সরকার শিশুদের জন্য বিনা বেতনে শিক্ষার ব্যবস্থা করলেও পরিবারের সদস্যদের অবহেলা, অশিক্ষা, অজ্ঞতা ও পরিবেশের কারনে এসব পরিবারের শিশুরা এগিয়ে যাচ্ছে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎতের দিকে। এ বিষয়ে বরিশাল জেলা শিশু বিষয়ক কর্মকর্তা পংঙ্কজ রায় চৌধুরীর সাথে আলাপ করলে তিনি এই প্রতিবেদককে জানায়, বরিশাল জেলা শিশু বিষয়ক কর্মকর্তা’র অধিনে ঝুঁকিপূর্ন শিশু বা ঝড়ে পরা শিশুদের নিয়ে কাজ করার কোন বাজেট বা কার্যক্রম নাই। এটি মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের বিষয়। শিশুদের নিয়ে (ই ই সি আর) প্রকল্প স্টাইপেন কাজ করে। তবে তারা বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের অধীনে বেশ কয়েকটি বস্তি বা কলোনীর ঝুঁকিপূর্ন ও সুবিধা বঞ্চিত প্রায় ৩ শতাধিক শিশুদের তাদের আওতায় এনে শিক্ষা ও সুষ্ঠু ভাবে বেড়ে ওঠার কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। এটা সরকারের একটি নিয়মিত প্রকল্প। বরিশাল শিশু অধিকার রক্ষা কমিটির সভাপতি জীবন কৃষ্ণ দে জানান, ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় নিয়োজিত শিশুর সংখ্যা বরিশালে ১০ হাজারের ওপরে। দেশের অধিকাংশ শিশুর পরিবার দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে, তাই শিশুশ্রম বন্ধ করা কঠিন। তবে যতটা সম্ভব ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় নিয়োজিত না করে শিশুদের সুযোগ-সুবিধা দেওয়া উচিত। এই বিষয়ে ইউনিসেফ ডিভিশনাল চীফ এ.এইচ. তৌফিক আহমেদ জানালেন, ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম নিয়ে আইন থাকলেও তার যথাযথ বাস্তবায়ন হচ্ছে না । সরকারিভাবে কোনো আন্তরিকতা না থাকাই এর মূল কারণ। এছাড়াও শ্রম মন্ত্রণালয়ে যে শিশুশ্রম নিয়ে মনিটরিং সেল আছে তারা যদি শক্তিশালী ভাবে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম নিয়ে প্রচারণা চালাতো তাহলে দ্রুত এই বিষয়টির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়া যেত বলে জানালেন এই বিশেষজ্ঞ। আইএলও সনদে যুক্ত হয়ে বাংলাদেশ ২০১৬ সালের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম পুরোপুরি বন্ধ করবে বলে অঙ্গীকারবদ্ধ ছিল । কিন্তু বাস্তবতা একেবারেই ভিন্ন বলে জানান তিনি। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে সমন্বয় আর সরকারি-বেসরকারি উন্নয়ন অংশীদারদের আন্তরিকতা বাড়িয়ে সামাজিক জাগরণের মাধ্যমেই শিশুশ্রম প্রতিরোধে সাফল্য সম্ভব বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। অপরদিকে বরিশালের ঝড়ে পড়া শিশুদেরকে এখনই সরকারের সুরক্ষার পাশাপাশি তাদের কে সুষ্ঠু ভাবে বেঁেচ ওঠার ও শিক্ষার মাধ্যমে বরিশালকে একটি শিশু বান্ধব নগরী হিসাবে গড়ে তোলার আহবান জানান বরিশালের সচেতন মানুষ। সোহানুর রহমান