বাল্যবিবাহ বন্ধে নতুন আইন দ্রুত পাস করা দরকার
জনসংখ্যা, মাতৃ ও শিশুমৃত্যু, অপুষ্টি ও পারিবারিক নির্যাতন কমাতে বাল্যবিবাহ বন্ধ করতে হবে। বাল্যবিবাহ দেশের জন্য সমস্যা হয়ে আছে। বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনের যে খসড়া সরকার চূড়ান্ত করেছে, সংসদে তা দ্রুত পাস হওয়া দরকার। একই সঙ্গে সচেতনতা বাড়াতে ও আইনটি বাস্তবায়নে জেলাভিত্তিক দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হবে।
গতকাল শনিবার ‘১৮ বছরের আগে বধূ নয়—শিশুবিবাহ বন্ধে সমন্বিত উদ্যোগ ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকের আলোচকেরা এসব কথা বলেন। প্রথম আলো এ বৈঠকের আয়োজন করে। এতে সহায়তা করে বেসরকারি সংস্থা ওয়ার্ল্ড ভিশন।
বৈঠকে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি বলেন, বাল্যবিবাহ দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সমস্যায় পরিণত হয়েছে। সমস্যাটি সরকারের একার পক্ষে সমাধান করা সম্ভব নয়। প্রতিমন্ত্রী বলেন, এ বছরেই ১৯২৯ সালের বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনটি বাতিল করে শক্তিশালী নতুন আইন করা হবে। নতুন আইনে বিয়ের বয়স প্রমাণে এফিডেভিট বা নোটারি পাবলিকের সনদ গ্রহণযোগ্য হবে না। আইন লঙ্ঘনের শাস্তিও বাড়ানো হচ্ছে।
রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকের সঞ্চালক ছিলেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম। তিনি বলেন, দেশে ১৮ বছরের কম বয়সী ৬৬ শতাংশ মেয়ে বাল্যবিবাহের শিকার। শিশুরা বিয়ের পর আরেক শিশুর জন্ম দিচ্ছে। মা ও শিশু দুজনেই স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছে।
অনুষ্ঠানে জানানো হয়, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় বাল্যবিবাহ বন্ধে নতুন আইনের খসড়া চূড়ান্ত করেছে। খসড়াটি মন্ত্রিসভায় তোলার অপেক্ষায় আছে। গোলটেবিল বৈঠক থেকে সংসদে আইনটি দ্রুত পাস করানোর দাবি জানানো হয়।
সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা বলেন, বাল্যবিবাহ বা শিশুবিবাহ বন্ধ করা সম্ভব হলে জনসংখ্যা, মাতৃ ও শিশুমৃত্যু এবং বিকলাঙ্গ ও অপুষ্ট শিশুর জন্মহার কমানো সম্ভব হবে। পারিবারিক নির্যাতনও কমে যাবে। বিয়ের জন্য বয়স প্রমাণে ডিজিটাল জন্মনিবন্ধন সনদ দেখানোর বিষয়টি আইনে বাধ্যতামূলক করার সুপারিশ করেন তাঁরা। আইন ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বাজেট বরাদ্দের বিষয়ে গুরুত্ব দেন তাঁরা।
ওয়ার্ল্ড ভিশনের অ্যাডভোকেসি ব্যবস্থাপক সাবিরা নূপুর ওয়ার্ল্ড ভিশন ও জাতীয় মানবাধিকার কমিশন পরিচালিত ‘ব্রাইড নট বিফোর ১৮’ শীর্ষক প্রচারাভিযানের ফলাফল উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন, এক বছর আগে প্রচারাভিযান শুরু হয়। তখন বাল্যবিবাহের কারণ হিসেবে অনেক শিশু বলেছিল, লেখাপড়া শিখে মেয়ে অনেক ভালো কিছু করছে—অভিভাবকদের সামনে এমন আদর্শ ব্যক্তি (রোল মডেল) না থাকায় অভিভাবকেরা মেয়েদের বিদ্যালয়ে পাঠানোতে ভরসা পান না, বিয়ে দিয়ে দেন।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের স্থায়ী সদস্য কাজী রিয়াজুল হক নতুন আইনে ছেলেদের বিয়ের বয়স ২১ না করে মেয়েদের মতোই ১৮ বছর করার সুপারিশ করেন।
স্থানীয় সরকার বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব মনজুর হোসেন ইউনিয়ন পরিষদসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকে কার্যকর করা ও জন্মনিবন্ধন কার্যক্রমকে শক্তিশালী করার আশ্বাস দেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের চেয়ারম্যান তানিয়া হক বলেন, শিশুবিবাহের ভয়ংকর পরিণতি পারিবারিক সীমা অতিক্রম করে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সমস্যায় পরিণত হয়েছে। একেক এলাকায় একেক কারণে শিশুবিবাহের ঘটনা ঘটছে।
জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের সেক্রেটারি নাছিমা আক্তার বলেন, ইউনিয়ন পরিষদের ‘ওয়ার্ড সভা’ করা বাধ্যতামূলক। এ সভায় চেয়ারম্যান শিশুবিবাহ প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেন। এ ছাড়া জনসচেতনতা তৈরিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে কাজে লাগানোর সুপারিশ করেন তিনি।
তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সহসভাপতি শহিদ উল্লাহ আজিম বলেন, পোশাকশিল্প শিশুবিবাহ প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে শিশুবিবাহ প্রতিরোধে আরও কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।
ওয়ার্ল্ড ভিশনের অ্যাডভোকেসি পরিচালক চন্দন জেড গোমেজ বলেন, সচেতনতামূলক কার্যক্রমে ইমামদের সম্পৃক্ত করে সুফল পাওয়া গেছে। ইমামরা যাতে খুতবার সময় শিশুবিবাহ প্রতিরোধ ও শিশুবিবাহের কুফলের কথা বলেন, সে জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে প্রজ্ঞাপন জারির সুপারিশ করেন তিনি।
সেভ দ্য চিলড্রেনের ব্যবস্থাপক (শিশু সুরক্ষা) খালেদা আকতার বলেন, শিশুবিবাহ যৌন নির্যাতনের হাতিয়ার। তিনি বাবা-মা ও অভিভাবকদের সচেতনতা বাড়ানোর ওপর জোর দেন। তবে যেসব শিশুর বিয়ে হয়ে গেছে, তাদের সুরক্ষায় কার্যক্রম হাতে নেওয়ার কথা বলেন প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের শিশু সুরক্ষা উপদেষ্টা জান্নাতুল ফেরদৌস।
বাল্যবিবাহ ঠেকাতে শিশুদের অভিজ্ঞতা: বৈঠকে ওয়ার্ল্ড ভিশনের শিশু ফোরামের তিনজন শিশু সদস্য উপস্থিত ছিল। দক্ষিণের জেলা সাতক্ষীরা থেকে আসা ১৪ বছরের সরদার কাজল বলে, ‘অনেকে বলে, এখন বিয়ে বন্ধ করতে আসছ, পরে কি তুমি আমার মেয়েকে বিয়ে করবে?’ অন্য ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে সে বলে, এক সহপাঠীর বিয়ে বন্ধ করতে গিয়েছিল তারা। অভিভাবকেরা সহপাঠীর জন্মনিবন্ধন সনদে লেখা বয়স দেখান ২০ বছর। তখন কাজলদের আর কিছুই করার ছিল না।
একই জেলার ১৩ বছরের সুরঞ্জনা সানা বলে, ‘শিশুবিবাহ বন্ধ করার কথা বললে বড়রা বলেন, “তুমিও শিশু, আবার মেয়েলোক, এত কথা বলো কেন।”’
রংপুরের মেহেদি হাসান ফোরামের সদস্য হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত চারটি শিশুবিবাহ ঠেকাতে সহায়তা করেছে। তার মতে, এ ধরনের বিয়ে বন্ধ করতে ইউনিয়ন পরিষদসহ সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা নিজ দায়িত্ব পালন করেন না।