একাকি শিশুর অনেক সমস্যা !
‘বাসায় থাকলে সারা দিন টিভি দেখি আর কম্পিউটারে গেমস খেলি। কিন্তু এসব ভালো লাগে না। সব সময় ইচ্ছে করে মায়ের সঙ্গে থাকতে! একা একা খুব খারাপ লাগে।’ কথাগুলো বলছিল শামা। সে রাজধানীর একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী। ওর মা-বাবা দুজনই কর্মজীবী। মা পেশায় সাংবাদিক। কথা হলো শামার মা আফরোজা ইসলামের (ছদ্মনাম) সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘শামা যখন ছোট ছিল, তখন বেশি সমস্যা হয়েছে। আমি আর আমার স্বামী দুজনেই চাকরি করি। দুজনেই যখন বেরিয়ে যেতাম, তখন ও কার কাছে থাকবে, এই নিয়ে ভীষণ চিন্তা হতো। প্রথম প্রথম বুয়ার কাছে রেখে যেতাম। শামার তখন আড়াই বছর বয়স। একদিন ওর জন্য দুধ বানিয়ে ফ্রিজে রেখে এসেছিলাম। বুয়াকে বলেছিলাম তিন ঘণ্টা পর গরম করে খাওয়াতে। আট ঘণ্টা কাজ শেষ করে বাসায় ফিরে দেখি, ফ্রিজে দুধ ওই রকমই আছে। বুয়াকে জিজ্ঞেস করায় তিনি বললেন, ‘‘কান্দে নাই, তাই খাইতে দিই নাই।’’ বুয়ার কাছে মেয়েকে রেখে যেতে আর ভরসা পেলাম না। আমার মায়ের বাসায় রেখে আসতাম। অফিস শেষে আবার সেখান থেকেই নিয়ে আসতাম! কী করব! আমার অফিসে তো কোনো শিশু দিবাযত্নকেন্দ্র নেই। তাহলে হয়তো এত সমস্যায় পড়তে হতো না।’ সিমিন পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। ওর মা-বাবা দুজনই বাইরে কাজ করেন। ফলে দিনের বেশির ভাগ সময়ই ওকে একা থাকতে হয়। একা থাকার ফলে তার কিছু মানসিক সমস্যা তৈরি হয়েছে। সিমিন বলে, ‘একা একা থাকতে ভালো লাগে না। বাইরে যাওয়াও বারণ । তখন আর কী করব! কল্পনায় বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলি। মনের মধ্যেই বন্ধুদের ডাকি। ওদের সঙ্গে খেলি।’ সিমিনের মা জানান, ‘মেয়ে হয়তো অনেক দিন ধরেই এই সমস্যায় ভুগছে। তবে আমরা এটা বুঝতে পেরেছি মাত্র কিছুদিন আগে। দেখতাম, মেয়ে বিড়বিড় করে কী যেন বলে। আর একা থাকতে পছন্দ করে। আমরাও কিছু বললে খুব বিরক্ত হতো। তারপর ডাক্তার দেখালাম। এখন নিয়মিত ওর কাউন্সেলিং চলছে।’ শামা ও সিমিন একক পরিবারে বাস করে। আবার তাদের দুজনেরই মা-বাবা চাকরিজীবী। ফলে তারা মা-বাবার পরিচর্যা তেমন পাচ্ছে না। ফলে দুই শিশুরই বিভিন্ন ধরনের সমস্যা তৈরি হচ্ছে। বর্তমানে যৌথ পরিবারগুলো ভেঙে গড়ে উঠছে একক পরিবার। সংসারের প্রয়োজনে সেই পরিবারের মা-বাবা দুজনকেই চাকরি করতে হচ্ছে। নগরজীবনের এই বাস্তবতায় এসব পরিবারের শিশুরা দীর্ঘ সময় একা একা সময় কাটাচ্ছে। মুখোমুখি হচ্ছে নানা সমস্যার। অনেক সময় দেখা যায়, শিশুদের দেখাশোনা করার মতো কাউকে পাওয়া যায় না বলে অনেক মাকেই চাকরি ছেড়ে দিতে হচ্ছে। তেমনই একজন টুটুল আর মিতুলের মা ইয়াসমিন হোসেন। তিনি বলেন, ‘আমি ছোটবেলা থেকেই ব্যাংকার হতে চেয়েছিলাম। স্বপ্নপূরণও হয়েছিল। একটা বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি করতাম। তার কিছুদির পর ছেলে টুটুল হলো। প্রথম দিকে ওকে রেখে অফিসে যেতাম। সকাল ছয়টা থেকে প্রস্তুতি নিয়ে আটটায় অফিসে ছুটতাম। ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যেত। আর এদিকে ছেলেকে দেখাশোনার কেউ ছিল না। কাজের লোকের ওপর ভরসা করতে পারছিলাম না। তাই একদিন সিদ্ধান্ত নিলাম, চাকরি ছেড়ে দেব। দিলামও। সে-ও ১০ বছর আগের কথা। আমরা কয়েকজন একসঙ্গে নিয়োগ পেয়েছিলাম। সেই সহকর্মীদের বেতন এখন প্রায় ৮০ হাজার টাকা। এখন ভাবি, চাকরিটা না ছাড়লে মাস শেষে এতগুলো টাকা আমার হাতে আসত। এসব টাকা সংসারের কাজে লাগানোর পাশাপাশি নিজের অনেক শখও পূরণ করতে পারতাম।’ বর্তমানে অনেক নারী বিভিন্ন পেশায় নিযুক্ত আছেন। তাই ইচ্ছে থাকলেও তাঁরা সন্তানকে প্রয়োজনীয় সময় দিতে পারছেন না। কর্মজীবী মায়েরা শিশুদের বাড়িতে গৃহকর্মীর কাছে রেখে যান। ফলে দীর্ঘ সময় শিশুটি গৃহকর্মীর সঙ্গে বাস করে। গৃহকর্মীর গুণগত মান কম হওয়ার ফলে শিশটিরও গুণগত মান কমে যাচ্ছে। অন্যদিকে শিশুদের পরিচর্যার অনিয়ম, নির্যাতন ঘটছে এই গৃহকর্মীদের দ্বারাই। আবার অনেক সময় দেখা যায়, গৃহকর্মীর সহায়তায় শিশু চুরির ঘটনাও ঘটছে। আর এর ফলে যাঁরা বাসায় সন্তানকে একা বা পরিচারিকার কাছে রেখে যান, তিনি কর্মস্থলে গিয়েও কাজে মন দিতে পারেন না। আর এই একা একা বড় হওয়া শিশুরাও বিভিন্ন ধরনের সমস্যায় ভোগে। একক পরিবারের শিশুরা, যৌথ পরিবারের শিশুদের চেয়ে ভিন্ন মানসিকতার হয় এমনটাই বললেন ভিকারুননিছা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের আজিমপুর শাখার সহকারী শিক্ষক। তিনি বলেন, ‘আমি লক্ষ করেছি, একক পরিবারের বাচ্চারা কারও সঙ্গে মিশতে চায় না। বেশি মানুষ দেখলে ঘাবড়ে যায়। নিজের আনা টিফিন অন্যের সঙ্গে ভাগ করে খেতে পছন্দ করে না। প্রথম-দ্বিতীয় শ্রেণিতে প্রায়ই দেখা যায়, শিশুরা খুব কাঁদে। কারণ, তারা একা একা বড় হয়ে অভ্যস্ত। একক পরিবারের এই শিশুরা শুরুতে স্কুলেও আসতে চায় না। কিন্তু কিছুদিন পরই ঠিক হয়ে যায়। এই শিশুদের খুব বেশি শিশুর সঙ্গে বন্ধুত্বও হয় না। তাদের এক বা দুজন বন্ধু থাকে। আর যৌথ পরিবারে বড় হওয়া শিশুরা ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের হয়ে থাকে। তারা অনেক মানুষের সঙ্গে মেশে। অন্যের সঙ্গে সবকিছু ভাগ করে নিতে পছন্দ করে।’ কিছু ছোট ছোট উদ্যোগ এই শিশুদের শৈশবকে সুন্দর করতে পারে, এমনটাই জানালেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সমাজবিজ্ঞানী মাহবুবা নাসরীন। তিনি বলেন, ‘একক পরিবারের শিশুদের জন্য সমাধান হতে পারে কয়েকটি। যেমন, যৌথ পরিবার ভেঙে গেলেও পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ থাকতে হবে। প্রতিবেশীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকতে হবে। যাতে শিশুটি প্রতিবেশীর কাছ থেকে সাহচর্য পায়। শিশুকে বেড়াতে নিয়ে যেতে হবে। শিশুকে সময় দেওয়ার সময় পূর্ণ মনোযোগ তাকেই দিতে হবে। অন্যদিকে যেসব একক পরিবারের মায়েরা কর্মজীবী, তাদের প্রতিষ্ঠানে শিশু দিবাযত্নকেন্দ্র থাকা প্রয়োজন। প্রতিষ্ঠানে দিবাযত্নকেন্দ্র থাকলে, শিশুরা যেমন নিরাপদ থাকে, মায়েদের কাজের গুণগত মানও ভালো হয়।’ বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকে ২০০৬ সালে দিবাযত্নকেন্দ্র খোলা হয়েছে। এখানে বর্তমানে ৬৮টি শিশু সেবা পায়। ব্যাংকে কর্মরত মায়েরা খাবার বিরতির সময় সন্তানকে দেখে যেতে পারেন। আর বুকের দুধ খাওয়াতে হলে আরও বেশিবার দেখা করার সুযোগ পান। এখানে বাচ্চাদের পড়ালেখা, খেলাধুলা, খাওয়া ও ঘুমানোর ব্যবস্থা আছে। আর প্রতিষ্ঠানে শুধু নারী কর্মীই নন, পুরুষ কর্মীরাও তাঁদের সন্তানকে এখানে রাখতে পারেন। ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর নাজনীন সুলতানা বলেন, ‘এটা আমাদের দীর্ঘদিনের আন্দোলনের ফসল। আমি যখন এই প্রতিষ্ঠানে কাজ শুরু করি, তখন থেকেই এখানে একটি দিবাযত্নকেন্দ্র খোলার ব্যাপারে কাজ করছিলাম। পরবর্তী সময়ে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সহায়তায় এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। আমরা প্রতিটি শিশুর খরচের মাত্র ৩৫ ভাগ অর্থ অভিভাবকের কাছ থেকে নিয়ে থাকি। বাকি অর্থ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ভর্তুকি দেয়। এই ব্যবস্থার ফলে প্রতিষ্ঠানের মায়েরা খুব স্বস্তিতে কাজ করেন। যেটা প্রতিষ্ঠানের জন্যও লাভজনক। আবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই উদ্যোগ অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোকেও উৎসাহিত করতে পারে।’