বাংলাদেশে এক দশমাংশ জনগণ (২৪ বছর আগের জরিপ মতে যা প্রায় দেড় কোটি, এরপর সরকারী ভাবে আর কোন জরিপ হয়নি) বিভিন্ন ধরণের প্রতিবন্ধকতা নিয়ে সমাজব্যবস্থা থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন অবস্থায় বসবাস করছে। এদের মধ্যে প্রায় ৩২% দৃষ্টি প্রতিবন্ধি, ২৮% শারীরিক প্রতিবন্ধি, ২২% বাক্ ও শ্রবণ প্রতিবন্ধি, ৭% বুদ্ধি প্রতিবন্ধি আর বাকী ১১% বিভিন্ন ধরণের প্রতিবন্ধকতার স্বীকার । এদের বেশিরভাগই বাংলাদেশের নাগরিক হয়েও তাদের নাগরিক অধিকার শিক্ষা, কর্মসংস্থান, সর্বত্র প্রবেশের সুবিধা ও সামাজিক মর্যাদা থেকে বঞ্চিত।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের প্রকল্পের আওতায় জরিপ মতে শতকরা মাত্র ৪ জন শিশু প্রতিবন্ধি স্কুলে যাওয়ার সুযোগ পায়। প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন পরিকল্পনার সার্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষায় প্রতিবন্ধি শিক্ষার্থীদের কথা বলা হলেও বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে নেই তেমন কোন তথ্য বা সচেতনতা। নেই শিক্ষার্থীদের জন্যে প্রয়োজনীয় মুক্ত চলাচল ব্যবস্থা। উল্লেখ্য যে, দৃষ্টি, বাক্ ও শ্রবণ এবং বুদ্ধি প্রতিবন্ধি শিশুদের জন্যে প্রয়োজনের তুলনায় খুবই স্বল্প সংখ্যাক কিছু বিশেষ স্কুল থাকলেও শারীরিক প্রতিবন্ধি শিশুরা না পারে বিশেষ স্কুলে যেতে না পায় স্বাভাবিক স্কুলে যাওয়ার যথাযথ পরিবেশ। কারণ স্বাভাবিক স্কুলে শারীরিক প্রতিবন্ধিদের জন্যে যে ঢালু পথ বা র্যম্প থাকার কথা তা কিছু সংখ্যাক সরকারি স্কুল এবং দু’একটি বেসরকারি স্কুলে ছাড়া কোথাও নেই।
আমাদের দেশের মানুষের মাঝে একটি ধারনা বদ্ধমূল প্রতিবন্ধি শিশুরা বিশেষ স্কুল ছাড়া স্বাভাভিক স্কুলে অন্যান্য বাচ্চাদের সাথে পড়তে পারবে না। প্রতিবন্ধি শিশুরাও যে শিক্ষা অর্জন করে নিজেকে প্রমান করতে কিংবা আমাদের সমাজকে কিছু দিতে পারে এ কথা অধিকাংশ পরিবারই এবং আমাদের তথাকথিত ভদ্র সমাজ ও শিক্ষকগণ বিশ্বাস করতে চান না। এমনতরো বিভিন্ন দিক থেকে বাধাগ্রস্থ হয়ে অভিভাবকগণ ভাবতে শুরু করেন প্রতিবন্ধি শিশুটিকে ঘরেই শিক্ষা দেই কিংবা শিক্ষিত হয়ে সে করবে টাই বা কি! কে কি বলবে বা কে কি ভাববে এবং বিভিন্ন ধরণের সমস্যার সম্মুখীন হয়ে অভিভাবকগণ প্রতিবন্ধি শিশু বা ব্যক্তিটি কে আবদ্ধ করে ফেলেন চার দেয়ালের ভেতর।তাদের সবকিছুতেই হয়ে যায় ‘না’।স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় -“না”। জন্মদিন বা বিভিন্ন পারিবারিক অনুষ্ঠান –“না”।বিয়ে বাড়ী –“না”। পাবলিক বাস বা ট্রেন –“না”। বিনোদন কেন্দ্র বা খেলার মাঠ তাতেও –“না”। আমাদের তথাকথিত সমাজ ব্যবস্থায় এই “না” এর আবর্তে পরে হাবুডুবু খাচ্ছে বাংলাদেশের প্রতিবন্ধি শিশুরা। যারা প্রতিবন্ধিদের মানুষ বলে মনে করেন না কিংবা তাদের দেখে হাসাহাসি বা বিরূপ মন্তব্য করতে দ্বিধাবোধ করেন না আমি তাদের কথা বলছি।বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষই কেনো এমন করে ভাবতে পারেন না- তাদের ঘরেও একজন প্রতিবন্ধি শিশু থাকতে পারতো! করুণা নয় একটু সহযোগীতার হাত বাড়িয়ে দিলে প্রতিবন্ধি শিশুরাও পারবে রাষ্ট্রের দক্ষ জনশক্তিতে পরিণত হতে। এর জন্যে প্রয়োজন ব্যাপক জনসচেতনতা। আমাদের শক্তিশালী গণমাধ্যম এবং সুশীলসমাজ এতে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারেন। প্রতিবন্ধিতা বিষয়ক তথ্য সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া গেলে সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি পরিবার ও সমাজ প্রতিবন্ধি ব্যক্তিদের যথাযথ মূল্যায়ন করবে। সমাজ তাদেরকে বিভিন্ন কর্মকান্ডে অংশগ্রহণের সুযোগ দেবে। সুশীল সমাজের নৈতিক দায়িত্ব প্রতিবন্ধি শিশুদের হারানো আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করা এবং তাদের প্রাপ্য অধিকার কে “না” না বলে “হাঁ” বলতে সাধারণ মানুষকে সচেতন করে তোলা। তাহলেই তাদের দক্ষতা ও সক্ষমতা তৈরী হবে এবং তারা নিজেদের এই সমাজের বোঝা ভাববে না। এতেই প্রমাণ হয় প্রতিবন্ধি কল্যাণ আইন ২০০১ এ তাদের সম্মানজনক ও মর্যাদাপূর্ণ জীবন নিশ্চিত করার কথা বলা হলেও তা কতটুকু বাস্তবায়িত হচ্ছে।
পাল্টে কি দেওয়া যায় না বিশৃংখলিত এই সমাজ ব্যবস্থাকে? জাগিয়ে কি তোলা যায় না ঘুমন্ত এই মানুষগুলোকে? আমূলে বদলে কি দেওয়া যায় না মানুষের এই চিন্তাধারাকে? আর কত পিছিয়ে থাকবে প্রতিবন্ধি শিশুরা?
জাওয়াদুল করিম জীসান, সভাপতি, এনসিটিএফ, বগুড়া।